বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার যৌথ আয়োজনে উপমহাদেশের প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরীর জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে আয়োজন করা হয়েছে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালা।
উপমহাদেশের কিংবদন্তী নৃত্যপরিচালক নৃত্যচার্য বুলবুল চৌধুরী’র জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আগামী ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায় জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরীর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করবেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, এমপি। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী এবং বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করবেন বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতি মিনু হক।
এছাড়াও বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালায় থাকবে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ, আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবসে নৃত্য উৎসব আয়োজন, নৃত্যনাট্য উৎসব, দেশব্যাপী নৃত্য প্রতিযোগিতা, ‘বুলবুল চৌধুরী’র নৃত্যধারা’ বিষয়ক সেমিনার, গুনী শিল্পীদেরকে সম্মাননা প্রদান-সহ বছরব্যাপী নানা কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরী ১ জানুয়ারি ১৯১৯-এ জন্মগ্রহণ করেন। জাতীয় পর্যায়ে নৃত্যচর্চায় বিশেষ অবদানের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও তাঁর সমান খ্যাতি রয়েছে। তার নামানুসারে বুলবুল ললিতকলা একাডেমী নামে বাংলাদেশে স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র রয়েছে। নৃত্যশিল্পের বাইরে তিনি লেখক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।
বুলবুল চৌধুরী
প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরী। প্রকৃত নাম রশীদ আহমদ চৌধুরী, ‘বুলবুল চৌধুরী’ তাঁর ছদ্মনাম। ১৯১৯ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া থানার চুনতি গ্রামে তাঁর জন্ম। পাঁচ বছর বয়সে গৃহশিক্ষকের নিকট আরবি-ফারসি শেখার মধ্য দিয়ে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯২৪ সালে তিনি হাওড়া প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। তারপর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের পর ১৯৪৩ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। শৈশব থেকেই নাচ, গান, ছবি আঁকা এবং গল্প-কবিতা লেখার প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ জাগে। ১৯৩৪ সালে মানিকগঞ্জ হাইস্কুলে অনুষ্ঠিত এক চিত্র প্রদর্শনীতে তাঁর আঁকা ছবি প্রথম পুরস্কার লাভ করে। তবে নৃত্যশিল্পী হিসেবেই তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। মানিকগঞ্জ হাইস্কুলের এক বিচিত্রানুষ্ঠানে স্বরচিত ‘চাতক-নৃত্য’ পরিবেশনের মাধ্যমে তাঁর নৃত্যশিল্পী জীবনের সূত্রপাত ঘটে। ছাত্রাবস্থায় প্রেসিডেন্সি কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে নৃত্যশিল্পী হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি সাধনা বসুর সঙ্গে যৌথভাবে পরিবেশন করেন রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত নৃত্যনাট্য কচ ও দেবযানী। এটি ছিল তাঁর শিল্পীজীবনের মাইলফলক।
১৯৩৭ সালে ওরিয়েন্টাল ফাইন আর্টস অ্যাসোসিয়েশন (OFA) প্রতিষ্ঠায় বুলবুল চৌধুরী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নাচের সঙ্গে অভিনয় যোগ করে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য পরিস্ফুট করে তোলাই ছিল তাঁর নৃত্যনাট্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাঁর নৃত্যনাট্যের বিষয়বস্তু ছিল বিচিত্র ধরণের এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন। যেমন হিন্দু-মুসলিম পুরাণ কাহিনী ও রূপকথা, লোককাহিনী, ঐতিহাসিক চরিত্র, সামাজিক সমস্যা, সমকালীন ঘটনা, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি। তাঁর নৃত্যের ধরণ ছিল অনন্য, ব্যতিক্রমী এবং অভিব্যক্তি-নির্ভর। বিষয়বস্তুুর নতুনত্ব ও কল্পনাশক্তির গভীরতায় সমৃদ্ধ তাঁর নৃত্যনাট্যগুলো দেশেবিদেশে সর্বত্র দর্শকদের প্রশংসা অর্জন করেছে। ব্যালে নৃত্যের আঙ্গিকে তিনি জাতির আশা-আকাক্সক্ষাকে মূর্ত করে তুলেছেন। তাঁর স্ত্রী আফরোজা বুলবুলও একজন প্রতিভাময়ী নৃত্যশিল্পী এবং তাঁর যথার্থ নৃত্যসঙ্গী ছিলেন।
নৃত্যশিল্পকে জীবনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, বিশেষ করে সে যুগের রক্ষণশীল সমাজে নৃত্যকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে বুলবুল ছিলেন পথিকৃৎ। ১৯৪০ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি নাচের দল নিয়ে ঢাকায় এসে কয়েকটি নৃত্যনাট্য পরিবেশন করে দর্শকদের মুগ্ধ করেন। ১৯৪১ সালের ৩১ মার্চ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘কলকাতা কৃষ্টি কেন্দ্র’। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি চট্টগ্রামে আসেন এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। দেশ বিভাগের পর বুলবুল তাঁর শিল্পিজীবনে ফিরে যান। ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে নৃত্যানুষ্ঠান করে প্রশংসা অর্জন করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি নাচের দল নিয়ে ইউরোপ যান এবং ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ড, হল্যান্ড, বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে নৃত্যনাট্য পরিবেশন করেন। ১৯৩৪ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ৭০টি নৃত্যনাট্য রচনা এবং সফলভাবে পরিবেশন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নৃত্যনাট্য হচ্ছে: অভিমন্যু, ইন্দ্রসভা, সাপুড়ে, সুধন্বা, কবি ও বসন্ত, মরুসঙ্গীত, ফসল উৎসব, তিন ভবঘুরে, জীবন ও মৃত্যু, শিব ও দেবদাসী, অজন্তা জাগরণ, অর্জুন, কালবৈশাখী, দি রেইনবো ফেয়ারিজ, হাফিজের স্বপ্ন, ইরানের পান্থশালায়, সোহরাব ও রস্তুম, ক্ষুধিত পাষাণ, মহাবুভুক্ষা, নিষ্প্রদীপ, যেন ভুলে না যাই, প্রেরণা, বিদায় অভিশাপ, ক্রাইসিস, শৃঙ্খলের নিপীড়নে, দেশপ্রেমিক, ভারত ছাড়, আনারকলি, ননীচোর, চাঁদ সুলতানা, বীতংস, রাসলীলা প্রভৃতি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে তিনি প্রাচী (১৯৪২) শিরোনামে একটি উপন্যাস রচনা করেন। এছাড়া তাঁর লেখা কয়েকটি ছোটগল্পও রয়েছে। ১৯৫৪ সালের ১৭ মে কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। নৃত্যশিল্পে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর নামে ১৯৫৫ সালের ১৭ মে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় বুলবুল ললিতকলা একাডেমী।