লালন ভক্তদের বিপুল সমাগম ও প্রাণবন্ত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ৩ দিনব্যাপী ‘লালন স্মরণোৎসব’
“লালন চর্চায় যেকোনো পদক্ষেপ নিলে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।”- ড. আসিফ নজরুল, মাননীয় উপদেষ্টা, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়
জাতীয় বাজেটে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ একেবারেই সামান্য। মহাত্মা লালন সাঁইজির ১৩৪তম তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে শিল্পকলা একাডেমির এই স্মরণোৎসবে আমি আহ্বান জানাই যেন রাষ্ট্র স্বীকার করে শিল্পকলা সমাজ জীবনের, রাষ্ট্র জীবনের কেন্দ্রে অবস্থিত।”- অধ্যাপক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ, মহাপরিচালক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।
৩ দিনব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত ‘লালন স্মরণোৎসব’ 2024। মহাত্মা লালন সাঁইজির ১৩৪তম তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ১৭-১৯ অক্টোবর এ স্মরণোৎসব আয়োজিত হয়েছে। লালন ভক্ত ও অনুরাগীদের বিপুল উপস্থিতিতে সেমিনার, লালন সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনার জমজমাট আয়োজনের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়েছে স্মরণোৎসব।
সমাপনী দিনের আয়োজনের ১ম পর্ব গতকাল ১৯ অক্টোবর বিকাল ৪টায় জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে ‘জাতিসত্তার প্রশ্ন এবং বাউল-ফকির পরিবেশনার রাজনীতি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রাণবন্ত ও বিপরীতমুখী এ আলোচনায় ওঠে আসে লালন সাঁইজির উপর নির্মিত ও আরোপিত নানান বিষয়ের বিশ্লেষণ। আলোচনায় স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনা বিভাগের পরিচালক আব্দুল হালিম চঞ্চল। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক আ-আল মামুন। লালন “বাউল” নাকি “ফকির”, ধর্মীয় আদৌ কোন রীতি অনুসরণ না করার পরও নানান ভৌগলিক অবস্থানগত জায়গায় তাকে নানাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেসব বিষয় খোঁজার চেষ্টা করেছেন প্রবন্ধ উপস্থাপক ও আলোচকগণ। আলোচক হিসেবে ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ আজম; লেখক ও সাংবাদিক এবং পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ; নাট্যকার, লেখক ও গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. শাহমান মৈশান। সভাপতির বক্তব্য প্রদান করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ। লালন ভক্ত ও অনুসারী, ছাত্র- শিক্ষক এবং গবেষকদের প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ ও আলোচনায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে সেমিনার কক্ষ।
2য় পর্বে সন্ধ্যা ৭টায় জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে দেশবরেণ্য শিল্পীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় লালন স্মরণোৎসব 'ধরো মানুষ রূপ নেহারে’ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের শুরু্তেই ‘যন্ত্রে সাঁইজির দৈন্যবাণী’ পরিবেশনের মাধ্যমে অতিথিবৃন্দকে স্বাগত জানান যন্ত্রশিল্পীবৃন্দ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদান করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনা বিভাগের পরিচালক আব্দুল হালিম চঞ্চল। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক মাহবুব মোর্শেদ। সভাপতির বক্তব্য প্রদান করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন “আমাদের বাংলাদেশে শুধু রাজনৈতিক চর্চা না, অর্থনৈতিক চর্চা না, সমস্ত সাংস্কৃতিক চর্চাটাও একটি পরিবার বা একজন ব্যক্তির বন্দনার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছিল। ছাত্র-জনতার জুলাইয়ের ঐতিহাসিক যে গণবিপ্লব, এটার মধ্য দিয়ে আমাদের সেই শৃংখলের মুক্তি ঘটেছে। আজকে আমরা বাংলাদেশের সংস্কৃতি চর্চা করছি। আমরা যদি বাংলাদেশের সংস্কৃতির চর্চা করি তাহলে আমাদের অনিবার্যভাবে লালনের কথা বলতে হবে। লালন একটা মহাকাব্যিক জীবনযাপন করেছেন। এটা সাধারণ মানুষের জীবন না। উনাকে খুব অল্প বয়সে মৃত ভেবে একটা তীর্থ যাত্রায় তার সঙ্গীরা ফেলে দিয়েছিলেন। তারপর তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে উঠেছিলেন। এটার মধ্য দিয়ে বড় কিছু একটা করার আবাস ছিল। উনার মৃত্যুও একটা মহাকাব্যিক মৃত্যু।”
তিনি আরও বলেন, “একজন বাউল যখন সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কথা বলেন তখন তার চরিত্রের ব্যপ্তিটা অনেক বড় হয়ে উঠে। লালনের সৃজনশীলতা, গানে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল পর্যন্ত প্রভাবিত হয়েছেন। সংস্কৃতি চর্চার প্রধান জায়গা হতে পারে লালন চর্চা। লালনের গানের মধ্যে আত্মনুসন্ধান করা যায়, তার গানে মনের ভিতরের ময়লা, ক্লেদ, গ্লানি দূর হয়ে যায়। একটা ফিলোসপিক ব্যাপার আছে। লালন চর্চায় যেকোনো পদক্ষেপ নিলে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।”
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ বলেন “বিশ শতক থেকে অদ্যাবধি এই ভূখন্ডে, আমরা যাকে বাংলাদেশি বলি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ অমীমাংসিত প্রশ্ন থেকে যায় আমাদের জাতিসত্তাগত পরিচয়ে। এক ছিল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, যেখানে পাকিস্তান হয়েছে। তারপরে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ যেখানে বাংলাদেশ হয়েছে। আমি মনে করি এই দুই বিভাজনের বাইরে, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বাইরে লালন আমাদেরকে পোস্ট ন্যাশনাল, জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে একটা দর্শন দিতে পারেন। আমাদের একটা জায়গা দিতে পারেন এবং সে জায়গাটা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। লালন আমাদের দিতে পারে লিঙ্গ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে, জাতিসত্তার পরিচয়ের ঊর্ধ্বে, ধর্ম-শ্রেণি পরিচয়ের ঊর্ধ্বে - সেটা হলো মানুষ রতন। এখানেই লালন। এই লালন পোস্ট ন্যাশনাল। এই লালন নন ফ্যাসিস্ট। আমরা এই লালনকেই সেলিব্রেট করি।”
মহপরিচালক আরও বলেন “লালন আমাদের শিখিয়েছেন জ্ঞানতাত্ত্বিক আত্মজীবন কি করে রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের কেন্দ্রে স্থাপিত হয় শিল্পকর্মের মাধ্যমে। সংস্কৃতি হতে পারে একেবারে রাষ্ট্রের কেন্দ্রে। কারণ সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে মানুষের চিন্তার পরিবর্তন হয়। সংস্কৃতি সেই ক্ষেত্র যা মানুষকে উজ্জীবিত করেন। আমার মনে আছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গানটি শুনলে অনুপ্রাণিত হতাম। এবারও আমরা যখন যুদ্ধ করেছি, লড়াই করেছি, বিপ্লব করেছি - গান ও ছবি আঁকা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে। এই জন্যই রাষ্ট্র যেন সংস্কৃতিকে একেবারে কেন্দ্রে স্বীকার করে। জীবনের ও সমাজের কেন্দ্রে স্বীকার করে। জাতীয় বাজেটে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ একেবারেই সামান্য। মহাত্মা লালন সাঁইজির ১৩৪তম তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে শিল্পকলা একাডেমির এই স্মরণোৎসবে আমি আহ্বান জানাই যেন রাষ্ট্র স্বীকার করে শিল্পকলা সমাজ জীবনের, রাষ্ট্র জীবনের কেন্দ্রে অবস্থিত।”
সাংস্কৃতিক পর্বের শুরুতেই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কণ্ঠশিল্পীবৃন্দ সমবেত কণ্ঠে সাঁইজির ভাববাণী ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবে’ পরিবেশন করে। সংগীত পরিচালনায় ছিলেন সোহানুর রহমান। এরপর লালন ভাববাণীগুচ্ছ নিয়ে খণ্ডনৃত্য ‘সহজ মানুষ’ পরিবেশন করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নৃত্যশিল্পীবৃন্দ। সংগীত আয়োজনে ছিলেন নিঝর চৌধুরী এবং পরিচালনায় ছিলেন মেহরাজ হক তুষার। তারপর লালন সাঁইজির ভাববাণী পরিবেশন করেন বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন। এরপর লালন সঙ্গীত পরিবেশন করেন লালন গবেষক ও কণ্ঠশিল্পী সরদার হীরক রাজা। লালন সাঁইজির ভাববাণী ‘দেখনা মন ঝাকমারি এই দুনিয়াদারি’, ‘খাচার ভিতর অচীন পাখি’ পরিবেশন করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কণ্ঠশিল্পী আবিদা রহমান সেতু। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কণ্ঠশিল্পী আব্দুল্লাহেল রাফি তালুকদার পরিবেশন করেন ‘জাত গেল জাত গেল বলে’। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কণ্ঠশিল্পী রোকসানা আক্তার রূপসা পরিবেশন করেন ‘কৃষ্ণ প্রেমে পোড়া দেহ’ ও ‘আমার ঘরখানায় কে বিরাজ করে। এরপর লালন সাঁইজির ভাববাণী উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট বাউলশিল্পী ও সাধক বাউল শফি মন্ডল। সবশেষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির কণ্ঠশিল্পীবৃন্দের সমবেত কণ্ঠে সাঁইজির ভাববাণী ‘মিলন হবে কত দিনে’ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়।